Saturday, August 22, 2020

জীবন রে

 দেব - ব্রতকথা

আজ বাইশে অগাস্ট। পড়ার টেবিলে সারাটা বছর অক্লান্ত দাঁড়িয়ে থাকা কোনো এক ছবি ছাপিয়ে আরও ছবিদের পুনঃ প্রকাশদিন । ছবি মানে দৃশ্য , মানে সেপিয়া স্মৃতিবৃষ্টি । নস্টালজিয়া। যেমন- রাত সাড়ে তিনটের নিশুত প্রহর - রাসবিহারী এভেন্যুয়ের এক অপ্রশস্ত সবুজ শেওলা গলির শেষে ঘুপচি ঘর - টেবিলের ওপর ওষুধের শিশি সরানোর শিরশিরানি - হামানদিস্তায় পান চেঁচার অস্ফুট শব্দ  – নিস্তব্ধতা-প্রস্ফুটনের আগের মুহূর্ত - মালতীলতার হুলুস্থুলু - হারমোনিয়ামের ঝংকার - হৃদ মাঝারে সুর আগুনে রবি তপস্যা - নিরাশার সমুদ্র ছেড়ে পালতোলা পাখা - গ্রন্ডিগ মেশিনের মহাকাল স্পুল ঘুরছেন - দেবব্রত বিশ্বাস গাইছেন - চারা গাছ পুঁতছেন - রেকর্ড করছেন - যত্নে জল দিচ্ছেন - ভবিষ্যৎ গড়ছেন। যেমন ছাতা মাথায় ওই জীবন সায়াহ্নে পৌঁছানো অবসরি লোকটা : আহা কি নিষ্ঠায়, বিশ্বাসে গড়া - গাঁথনি , ঢালাই ভিজিয়ে দিচ্ছেন জলে। উত্তরাধিকারীরা - অনুসূয়া ,দীপকেরা থাকবে , বাঁচবে , বিপন্ন বিস্ময়ে খুঁজে পাবে আরো কিছু প্রাণের আরাম ছাতিম বিরাম আরও কিছু শিল্পী শ্রী দেবব্রত বিশ্বাসের গান। প্রতিবাদের স্লোগান !

'এক হাতে ওর কৃপাণ আছে, আর - এক হাতে হার/ও যে ভেঙেছে তোর দ্বার। / আসে নি ও ভিক্ষা নিতে , না না না- লড়াই করে নেবে জিতে / পরানটি তোমার ।

'কি বললেন - স্লোগান'?

'প্রতিবাদের স্লোগান। ওঁর একেকটি গান একেকটি প্রতিবাদের ভাষা , একেকটি প্রতিবাদের আগুন। নেমেসিস্। পঁচা ফুচকা , ডিজাইনার পাঞ্জাবি, জাবর কাটা , কবিগুরু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বারুদে ইস্তাহার।'

বলতে বলতে , মঞ্চ জুড়ে শত সূর্যের আচমকা ফেড ইন। বিরাট ওয়াইড এঙ্গেলে অনেক গুলো দেবব্রতর গুরুগম্ভীর, শতদল অনুভবে প্রস্ফুটিত কোরাস। ভালোবাসা,সূর্য আর তারাদের নাচিয়ে তোলার অনুরণ।

' না না না না না, মানব না , মানব না।'

'নবজীবনের গান।'

'দারুন অগ্নিবাণ ।'

'বটুকবাবুর স্মৃতিচারণ, 'লিখন সমগ্র - ১ ' :

একদিন দেখলাম মৃত্যু - অমৃতের সন্তানরা মরছে , যেন পোকামাকড়। মা মরে পড়ে আছে। তার স্তন ধরে অবোধ ক্ষুধার্ত শিশু টানাটানি করছে আর হেঁচকি তুলে কাঁদছে। এর প্রচন্ড অভিঘাত আমার গোটা অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে দিলো। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম - না , না , না। অস্থির পায়ে দৌড়তে দৌড়তে হেঁটে চলেছি আর মনে মনে বলছি - উই ওন্ট আলাউ পিপল টু ডাই। মানুষের তৈরী এই দুর্ভিক্ষ মানব না , প্রতিরোধ করবো , উত্তীর্ণ হবো। হাত মুঠি করে আবার বলে উঠলাম - না না না। এই হলো শুরু। জর্জের ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের বাড়িতে হারমোনিয়াম আর ধার করা কাগজ নিয়ে বসে গেলাম। সুর আর কথা , মনের বেদনা ও যন্ত্রণার রুদ্ধ উৎসমুখ থেকে ঝর্ণার মতো বেরিয়ে এলো।‘

রাজার দরবার থেকে দরবারী কানাড়া নেমে এলো মানুষের দরবারে। শুরু হলো নবজীবনের গান। । মানুষের জীবন-সংঘর্ষের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ,গামছা বেঁধে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে সহযাত্রী ,সংগ্রামী শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের গান। প্রতিবাদের স্লোগান।

এস মুক্ত করো , মুক্ত অন্ধকারের এই দ্বার/ এস শিল্পী , এস বিশ্বকর্মা , এস স্রষ্টা ,/ রূপ-রস-মন্ত্রদ্রষ্টা। / ছিন্ন করো, ছিন্ন করো বন্ধনের এই অন্ধকার।

১৯৪৩- ৪৪ সাল। 'পথে পথে মৃত্যুর শঙ্কা '। বাঙালির সাংকৃতিক ছাদ ফুটো করে রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন। হেমন্ত মুখার্জি প্রথম গান রেকর্ড করছেন।রংপুরের শিল্পী বিনয় রায় গাইছেন - তোমার কাস্তেটারে / জোরে দিও শান / কৃষাণ ভাইরে। 'সোনার তরী' নয় 'মধুবংশীর গলি'র' পাণ্ডুলিপি , প্রত্যয়ের দ্বীপ জ্বেলে শম্ভূ স্বরে উচ্চারিত হচ্ছে হাঠে -মাঠে শত-সহস্র রাজনৈতিক সভায়। সঙ্গী বলতে - কবি এবং রবিন মজুমদার। বিজন ভট্টাচার্য ,ভারতীয় ভাষায় প্রথম গণনাটক 'নবান্ন' লিখছেন। এবং দেবব্রত বিশ্বাস , রবীন্দ্রনাথের গানের বিকৃত খোকন মার্কা গা এলানো , ধরো ধরো ভাব ঘুচিয়ে বাংলাদেশের মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার দৃপ্ত সারাৎসার। সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে  অপমান।

১৯৪৩- ৪৪ সাল। উপদ্রুত রাস্তায় নামলো মোহিত ব্যানার্জির উত্তাল বাংলা তর্জমা 'জাগো জাগো জাগো সর্বহারা'। বেরুলো পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রান্টের প্রধান ফর্মুলেটার সাধারণ সম্পাদক পি সি জোশির ফরমান : নিজেকে সশস্ত্র করো। ভোঁতা বেয়োনেট বা ভাঙা ব্যারেলে কি কাজ হবে ?' উচ্চারিত হলো পার্টির নির্দেশ - শিল্পীদের অলরাউন্ডার হতে হবে। নাচ -গান - বাজনা - আবৃত্তি - অভিনয় , সবই কিছু কিছু শিখে রাখতে হবে , যাতে কোনো একজনের অভাবে কাজ না-ঠেকে যায়, এবং সমগ্রতার সাধক , অর্থাৎ পুরো মানুষ এবং পুরো শিল্পী। হরিন চট্টোপাধ্যায় , বিনয় রায়ের নেতৃত্বে তৈরী হলো দল ' ভয়েস অফ বেঙ্গল ।' কলকাতা , দিল্লি , লাহোর , মুম্বাই ঘুরে তোলা হলো ১,২৫,০০০ টাকা দুর্ভিক্ষ পীড়িতের জন্য। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয় তৃপ্তি, শম্ভূ, বিজন , বটুক , প্রেম ধাওয়ান,শান্তি বর্ধন , রবিশঙ্করের হাত ধরে আসমুদ্র হিমাচল পরিচিত হলো বাঙালির সৃষ্টিশীল সৃজনশীলতার সংগে। আর আদিষ্ট দেবব্রত বিশ্বাস ? তিনি প্রতিজ্ঞ মন রাখলেন  জায়গায় জায়গায় গিয়ে গান শেখাবার অভিযানে : হাওড়া ময়দানে রেলশ্রমিকদের , চাপদানি চটকল - মজুরদের , কালীঘাট ট্রাম শ্রমিকদের।

কথাগুলো বলতে বলতে আলেয়া সিনেমার পিছনের বাড়ির একতলায় , খালেদ চৌধুরীর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। শরীর খারাপ ডায়ালিসিস চলছে। শেষ বয়েসে আবেগের তালা চাবিগুলো কোথায় যে হারায়ে কে জানে !

অনুসূয়া অশীতিপর শিল্পীর সংগে কটা পছন্দসই ছবি তুলে , তাঁকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লো। য়ুনিভার্সিটির ইলেকশন আসন্ন। কিন্তু কোর কমিটির মিটিঙে সে আজ যাবে না। বাড়ি ফিরে এলো। আয়নার সামনে বসে সিগারেট ধরিয়ে দেখলো তুমুল বৃষ্টি এলো বলে । পাশের বাড়ির মাসিমা শাঁখ বাজাচ্ছেন। জানলাগুলো খোলা দরকার।

'কি রে , কি হলো ?'

'কিছু না। '

'তাহলে।'

'ভাবছি।আমরা রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র ধুয়ে আচমন করি কিন্তু এই আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতি , এই আজকের গান,নাটক,চলচিত্র এর ওপর ওই দামাল সময়ের, ওই গণনাট্য সংঘের সংগ্রামী শিল্পীদের প্রভাব কতটা গভীর , কতটা সুদূরপ্রসারী , সেটাই ভাবছি। আমরা এর কতটুকু জানি , কিংবা কতটুকু জানানো হয়েছে। নাকি এটাই ফ্যাক্ট যে নেতৃত্ব খুব সচেতন ভাবে নিজের মুখোশ ঢাকতে এইসব গুলিয়ে দিয়েছে। কোনটা ? কেন এই পর্বের ইতিহাস লেখা হয় নি ? বিশ্লেষণ করা হয়নি? ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির জীবনে তো সেই এক বার এবং দুর্ভাগ্যবশত শেষবার ধলেশ্বরী মাতলার ঢল নেমেছিল। তারপর থেকে তো সাম্যবাদী বৃন্দাবনে শুক সারির গপ্পো ম্রিয়মান। 'পটলডাঙার পাঁচালি' মুখ থুবড়ে পড়েছে 'পরমপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ'র চরণে।

আগামী প্রজন্ম কি শুধু দেবব্রত বিশ্বাস ক'বার কটা রসাত্মক বাঙাল ভাষায় রসিকতা করলো , মন্জুশ্রী চাকীকে মোটর সাইকেলে নিয়ে কোন কোন গলিতে ঘুরলো , ঘরের কোন দেয়ালে ম্যাডাম শ্রীমতি মিত্রের ছবি টাঙানো আছে , বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে কেমন করে সুবিনয় রায়কে বললো  - আমার হাতের লাঠিটাও অনেকের থিক্যা বেশি মেসকুলিন , শুধু এইসব দেবব্রত -প্রশস্তির ,মিথরঞ্জক পরচর্চার , হুজুগে আদিখ্যেতার নিরিখেই স্রষ্টার সৃষ্টির বিশ্লেষণ করে চলবে ? এসব করে আমরা তো আমাদেরই ঠকাচ্ছি, চেতনাকে অপমান করছি।

' আম কাসুন্দি নাটকও লিখছি '

'প্রগতির নামে রোদ্দুর রায়ের মতো সাংস্কৃতিক অভিশাপ কে বুকে পিঠে লালন করছি'।

'আজও তো স্টেশনে দুধের শিশু মায়ের মৃতদেহ টেনে নিয়ে যায়। আমরা সেদিনের সেই প্রত্যয় নিয়ে কেন লিখতে পারছি না - না না না/ মানব না মানব না। কোটি মৃত্যুৱে কিনে নেবো প্রাণপনে / ভয়ের রাজ্যে থাকবো না।'

'দায়ী কারা ?'

'নেতৃত্বে যারা। '

'আর আমাদের মতো শুয়ারের বাচ্চারা ?'

'সত্যকে জেনে,সত্যকে বুঝে,তবু মিথ্যেকে বিশ্বাস করি , যারা ।'

অনুসূয়া, দীপকদের মতো জর্জ বিশ্বাসও বুঝেছিলেন। তাই হেমাঙ্গ বিশ্বাস কে এক লম্বা চিঠিতে লিখলেন - গণ নাট্য আন্দোলনের ভিড়ে ছিলাম অনেক ব্যাপারে বিশ্বাস করে। ভেবেছিলাম গণ চেতনায় দেশকে উদ্বুদ্ধ করে দেশে বিপ্লব আনবো। কিন্তু বহু বছর পরে দেখলাম, গ্রাম গঞ্জে , হাটে-মাঠে , গান গেয়ে , 'শহীদের ডাক' দেখিয়ে আধ ইঞ্চিও প্রবেশ করতে পারি নাই। সুতরাং -জনগণ যেখানে ছিল সেখানেই আছে। খামোখা ভুল পথে গিয়ে পড়েছিলাম। নিজের ভুল স্বীকার করছি। আমাগো দ্যাশের লেনিনগুলি সত্যই সব ফলস।একদা আনন্দ নিকেতন এখন ধান্দা নিকেতনে পরিণত হয়েছে।'

সেই শুরু : বাংলা শিল্প সংস্কৃতির অন্তর্জলি যাত্রার ; 'বৈশাখী ঝড়' তুলে পার্টির ছাদনাতলায় শিল্পবাজারের কায়েমী স্বার্থ গড়ে তোলবার প্রচেষ্টার ; জানলা খুলে পর্দা সরিয়ে প্রশ্ন করবার :

হরপ্রসাদ: রাইত কত হলো ? উত্তর মেলে ন। চালাও আমি পিছনেই আছি। কাল সকালে গ্রামবাসীরা হতবাক হয় দেখবে জোড়া মৃতদেহ ঝুলছে।

ঈশ্বর: হরপ্রসাদ তুমি ?

হরপ্রসাদ: না। আমার প্রেতাত্মা। হেরে গেছি আমি। সর্বশান্ত। নড়ি , চড়ি , আছি ! বাজে পোড়া তালগাছ। প্রতিবাদ করেছিলাম। কার প্রতিবাদ ? কিসের প্রতিবাদ ? এখন হয়ে গেসে , একটা দেয়ালে দাম কইরা ধাক্কা খাইয়া একটা যাঁতাকলে অন্ধ হইয়া আষ্টেপৃষ্টে আটকাইয়া আছি। --- আসল কথা কি জানো ভাইডি ও প্রতিবাদই করো আর ল্যাজ গুটাইয়া পলাইয়া যাও কিছুতেই কিছু যায় আসেনা।সব লোপাট। আমরা সব নিরালম্ব, বায়ুভূত। আমরা মিটে গেছি।

হরপ্রসাদ মাস্টারের মতো বাজেপোড়া তাল গাছদের মধ্যে ছিলেন , দেবব্রত বিশ্বাস , জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় , বিজন ভট্টাচার্য , শম্ভূ মিত্র , ঋত্বিক ঘটক , কেয়া চক্রবর্তী ।বুর্জোয়া প্রগতিশীল শিল্প 'কল্লোল' , 'অগ্রণী কিন্তু অধার্মিক' এঁদের নির্মম ভাবে একা করে দিয়েছিলো। এঁরা একটাই প্রশ্ন শেষ অবধি ফেরি করে বেরিয়েছেন : কেমন সুন্দরভাবে জীবনটা শুরু করেছিলাম। এই ভাবে শেষ হওয়াটা কি উচিত ? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে ? কোন রুদ্ধসঙ্গীতের নাট্যকার ? কলুষিত সংস্কৃতির উঠোনে পুঁজির কৌশলী দাপটে আমরা দিশেহারা।

হায় কমরেড ! আজ রেড রোডে তুমি শুধু মুখোশ পরে সঙ্গীহীন নিষ্ক্রিয় প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ড বয় ! হুনুমানের ছুঁড়ে ফেলা কলার ছীলায় দৈনিক পিছলে আবোলতাবোল ছড়া| কোনো 'ব্যারিকেড' গড়ে তোলার ক্ষমতা শেষ। সময়ের হাতে দ্বান্দ্বিক উপহাসের ভাঙা পাত্র |

কমরেড দাসগুপ্ত , ১৯৮২ সালে , ডিসেম্বর মাসে ছ দিন পরে আপনার মৃতদেহ যে শহর থেকে আনা হয়েছিল সেই রাজধানী বেজিঙে পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় একদা কমরেড , দেবব্রত বিশ্বাস, কমরেড চু এন লাইয়ের বাড়িতে ফরাশ পেতে , খাতা পেন্সিল নিয়ে দু ঘন্টার ওপর রবীন্দ্রনাথ , সুকান্ত , নজরুল সংগীত শুনিয়ে এবং বুঝিয়ে এসেছিলেন। খবরটা নিশ্চই আপনার জানা ছিল। যেমন জানা ছিল আপনারা দুজনেই হাঁপানি রুগী , এবং ১৯৮০ সালে , ১৮'ই অগাস্টের সেই মহাপ্রয়াণের দিন , শিল্পীর মৃতদেহ নিয়ে যাবার জন্য আলিমুদ্দীনের কাছে বার বার বরফের জন্য দরবার করতে হয়েছিল। প্রথাগত বাম ডিগবাজি।

কমরেড আপনাদের এই উদ্ভট ট্রেডিশন বজায় ছিল ২০০৩ সালেও - সুভাষ কবি যে ৮'ওই জুলাই মারা গিয়েছিলেন। সততার অপ্রতিরোধ্য তাগিদ থাকলে বোধহয় এদেশে তালেবরা কমরেড হওয়া যায় না কিংবা হয়তো কিছুই হয়ে ওঠা যায় না। একে একে তাদের বুকে গোলাপের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে চলে যেতে হয় আগুনের ঘরে।

জর্জ বিশ্বাসও জানতেন তাঁর এই ভবিতব্যের কথা। তবু তাঁর প্রতিজ্ঞ ইচ্ছা ছিল- মরণ হতে যেন জাগি গানের সুরে;যেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের - এই কথাটি মনে রেখো , আমি যে গান গেয়েছিলেম। জর্জ বিশ্বাস আর তার রবীন্দ্রগান, হাবা কুমোর আর তার প্রতিমা ভাস্কর্য : দুজনের ক্ষেত্রেই ছিল , খ্যাপার চলতে চলতে  খুঁজে পাওয়া সৃষ্টির পরশপাথর। সে মুক্তকচ্ছ হয়ে লেজ কাটারা শিল্পবোধের অভাবের তাড়নায় যতই বাজারে লিখুক ' কার গান ? কার সুর ?' কিংবা ' রবীন্দ্রনাথ 'স্টিম রোলার' চালানোয়ে আপত্তি করেছিলেন , বস্তুটা বাস্তবিক কি , সেটা দেখে বা শুনে যাননি। আরও দুঃখ হয় , যখন তন্নিষ্ঠ যথার্থ কোনো রবীন্দ্র অনুরাগী শিল্পীকে চালকের আসনে দেখি', সে যতই মিউজিক বোর্ড ব্যক্তি- স্বার্থ রক্ষার নীতির কুয়ো তলায় ঘুরপাক খেয়ে , জানলাবন্ধ জারজ অগভীরতায় আটকে অপবাদ দিয়ে থাকুক , ' বেড়াল দুধ খেয়েছে, ভাঁড় ভেঙেছে , মুখ মুছেছে কাঁথাতে।'

কোনো আর্ট কলেজ নয় গঙ্গাপাড়ে এঁটেল মাটিতে হাত ডুবিয়ে হাবা কুমোর প্রথম গণেশ গড়তে শিখেছিলেন। কোনো বিতানে নয় জর্জ বিশ্বাস বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া মাঝি মাল্লাদের সংগে চিৎকার করে ,ক্ষেত মজুর আর ভিখিরিদের সংগে গলা মিলিয়ে প্রথম গান গেয়েছিলেন। চাকরি করতে করতে ফিরে গেছেন সেই অন্ধ ভিখিরির কাছে , আবার আবার করে শুনেছেন - ওই নাম জপ বান্দা , আল্লাহর কালাম , লা লা ইল্লিল্লাহ তোর নাম। হাবা চাক ছেড়ে মাঝে মাঝে চলে যেতেন নিশিকান্তর মনোহারি দোকানে। অবাক হয়ে দেখতেন নানা রঙের পুতুলরা কিরকম কাঁচের বাক্সে হাসি খুশি দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে সাহা এন্ড কোম্পানির সাইকেলের দোকানে কলের গান চলতো আর সেখানে কিশোর গানখ্যাপা জর্জও আঙুরবালা , ইন্দুবালা নানারকম দেবীদের এবং কে মল্লিকের গানে সুরসিঞ্চিত হয়ে উঠতেন। গানের সঙ্গে আরো একটা যোগ ছিল: সে যখন দেবেন্দ্র ও অবলা বিশ্বাস দুজন বসতেন দু মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে সন্ধ্যা বেলায় দৈনিক উপাসনায়। জর্জের কাছে সেই আধ্যাত্মিক সুরের ব্রাহ্ম বন্ধন ওনার ভাষায় 'মানে একদম অত্যন্ত বোরিং ছিল ; ওই মা'ই গান করতেন সঙ্গে সঙ্গে আমি আর আমার দুই বোন কিছুক্ষন ব্যা ব্যা করতাম শেষ হলে পালিয়ে যাইতাম।' হাবা কুমোর জাতে সাঁওতাল ছিলেন। শেষ দিন পর্যন্ত হাঁড়িয়া খেতেন আর স্বকীয় দেশজ ঢঙে বাক্যালাপ করতেন। পুরস্কার বিতরণের ধোপ দুরস্ত মঞ্চে সবাইকার পাশে ,গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি এলোমেলো চুল ,বসতেন লুঙ্গি আর ফতুয়া পড়ে। আর সঙ্গে এক জোড়া আলাদা চোখ-কৌটোয় ভরে রাখতেন দিগন্তজোড়া চাহনি । জর্জ বিশ্বাস- আপনিও শেষ দিন পর্যন্ত জিভে জড়িয়ে রেখেছিলেন শিকড় শব্দ ব্রহ্ম, আপনিও এক মুখ দাড়ি গেরুয়া লুঙ্গি ফতুয়া হাতে লাঠি নিয়ে উঠেছিলেন সম্বর্ধনা মঞ্চে , আলোকিত প্রেক্ষাগৃহে মরা মনের ডালে ডালে তালে তালে নাচিয়ে ছিলেন সুরের আগুন । সে যেন ছিল ওই হাবা কুমোরের খোড়ো চালের নিচে প্রতিমার চক্ষুদানের প্রহরের মতো : যখন অনুভবের চোখ পেয়ে , চোখ ছাপিয়ে দৃষ্টি পেয়ে প্রতিমার অঙ্গে অঙ্গে জ্বলে উঠতো শত শত আলোর ঝলকানি; যখন অনুভবের আততিতে রবিব্রত কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীতের কথা , সুর ,লয়, তান, মাত্রা,ভাব,অনুভব বিধৃত হতো সুরের বিমূর্ততায়।

অনুসূয়ার বারান্দার আকাশে বৃষ্টি থেমে গেছে। মুখে এসে পড়েছে মেঘ ছেঁড়া আলো। চুল উড়ছে ভিজে বিলিকাটা হাওয়ায়। শ্যাওলা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। পাশে দীপক। দু হাতের তেলয়ে ফোস্কা। শক্ত করে কিছু ধরবার ক্ষমতা নেই। ডাক্তার অপেক্ষা করতে বলেছে।

অনুসূয়া: জানিস জর্জ বিশ্বাসকে মাঝে মাঝে মনে হয়ে ঋত্বিকের অযান্ত্রিক ছবির বিমল। অপরাহত তবু রবীন্দ্রনাথকে ছাড়েননি। ওনাকে বন্দুকে ভরে গেরিলার মতো ক্ষিপ্র ,দুর্বার গতিতে , সংস্কৃতির ঢাল বেয়ে নেমে এসেছেন, নরক-কলকাতার জন চেতনার মধ্যে। হি ক্র্যাশড ইন্টু আওয়ার কনশাসনেস উইথ রবীন্দ্রনাথ।

দীপক: মধ্যবিত্তের হৃদি - রাজপথে একের পর এক বোমা বর্ষণ। আকাশ ভরা সূর্য তারা , যে রাতে মোর দুয়ারগুলি , কেন চেয়ে আছো গো মা। মস্তিষ্ক ফাটানো - দুম !দুম!দুম!

অনুসূয়া: সংস্কৃতির সদ্য আগাছা শ্রীল রোদ্দুর রায়েরা শুনুন , আপনারা যাঁরা গলা ভারী করে মস্তিষ্কবিহীন দেবব্রত বিশ্বাস হতে চান তাঁরা শুনুন , আপনারা যাঁরা মাথায় গামছা বেঁধে রবীন্দ্রসংগীতকে নিয়ে নানা রকম আলতা আদুরী মিউজিক আরেঞ্জমেন্ট করে ওয়াই এস মুলকি-জর্জদা কম্বো করতে চান তাঁরা শুনুন, এই ঋষিজ শিল্পীর একটা নির্দিষ্ট দ্বান্দ্বিক সচেতন দৃষ্টিকোণ ছিল এবং আজও কালপটে ভীষণরকম আছে। সেখানে মধ্যবিত্তের মানসপট এফোঁড় ওফোঁড় করে জগদ্দল,বিমল,ঋত্বিক ,দেবব্রত,বিজন,শম্ভূ,জ্যোতিরিন্দ্র'রা আছড়ে পরার চরম মুহূর্তে বেজে ওঠে , অবরোহনের পর আরোহনের মঙ্গল শঙ্খ। সেখানে সজ্ঞান চৈতন্যে শিল্পী গেয়ে ওঠেন - যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে, জানি নাই তো তুমি এলে আমার দ্বারে। সেখানে মাথার হিসেবে কান শোনে , গলায় সর্গম খেলে।

দীপক: আপামর গিলেকরা শান্তিনিকেতনী বৈয়াকরণিকদের চরম অস্বস্তিতে ফেলে কাউন্টার- ন্যারেটিভ , ' মাউন্টবেটন সাহেব ও , তোমার সাধের বেটন কার হাতে থুইয়া গেলা ও ' , রেনোয়া'র 'দ্য রিভার' ছবিতে গাওয়া ভাটিয়ালি দিয়ে উপচানো লিপস্টিক পারফিউম জামদানি রবীন্দ্রসভা শুরু হয়। কিংবা লেনিন জন্ম শতবার্ষিকীতে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে মঞ্চে উঠে চলতি - পেত্রোগ্রাদ থেকে ভোলগার তীর থেকে কমরেড লেনিনের আহ্বান , না গেয়ে , গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায়ে ঘোর গেয়ে ছড়িয়ে দিলেন চুম্বনে চুম্বনে শত হৃদয়ে তন্ত্রীতে রবীন্দ্র বারুদ ডোর।

সত্যই জর্জ বিশ্বাস বঙ্গবাসীকে বেঁধেছিলেন রবীন্দ্র বারুদ ডোরে। জনৈক নন্দদুলালের মতো বেলোতে হাওয়া মেরে কম্পাসের কাঁটার মতো মাথা দুলিয়ে লবঙ্গ ভালোবাসার আদুরী গোলাপ নয় , ওনার ' ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে' পরিবেশনে , ঠাসা ভালোবাসার হৃদয় তছনচি বারুদ।

আমি কোনো মধ্যমেধা পুষ্ট মেরুকরণ করে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল খেলতে চাইছিনা তবু এখানে ইতিহাসের পাতা পাল্টে উপযুক্ত ঘটনার একটা প্রেক্ষিতপূর্ণ দৃষ্টান্ত দিতেই হচ্ছে। বিশ্বভারতী আশ্রমের ভেকধারী সর্বজ্ঞরা যখন জেনেছিলেন শ্রীমতি সুচিত্রা মিত্র ,সলিল চৌধুরীর 'সেই মেয়ে ' গান টি গেয়েছেন , তখন তাঁরা শিল্পীর সামনে উক্ত গানের রেকর্ড লাথি মেরে ভেঙে , চূড়ান্ত শর্ত দিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে শিল্পী শ্রীমতি মিত্র আপোষ করেছিলেন। সাহস করে আর ফিরে যাননি কোনো সলিলসঙ্গীতে। দেবব্রত বিশ্বাস , বাংলার পল রবসন , কিন্তু সেই ছাতিমতলার স্বৈরতন্ত্রের মুখে তুড়ি মেরে গেয়ে গেছেন ' তোমরা যা বোলো তাই বলো' আবার 'যদি কিছু আমারে সুধাও ' কিংবা ' অবাক পৃথিবী ।' বারবার বলে গেছেন - কার কথা মেনে নোবো ? রবীন্দ্রনাথ - না , যাঁরা নতুন নিয়মগুলি করেছেন , তাঁদের ? আমাদের মাতামহীর আমলের জীর্ণ কাঁথা দিয়ে ঘিরে রেখে এবং পলতেয় করে ফোঁটা ফোঁটা নিয়মের বিধান খাইয়ে রবীন্দ্রসংগীতকে টিকিয়ে রাখা যাবে এমন কথা রবীন্দ্রনাথ নিজে কি ভাবতে বা বলতে পেরেছিলেন কোনোদিন?

অনুসূয়া: এই শোন আজ বাইশ। যাবি?

দীপক: কোথায় ?

অনুসূয়া: জর্জ বিশ্বাসের বাড়ি।

দীপক: ফিশ এন চিপস আর দার্জিলিং টি।

অনুসূয়া: জানিস উনি খাওয়াতে বেশ ভালোবাসতেন। রান্নাটাও যুৎসই করতেন। মাংস আর খিচুড়ি রান্না করতে করতে বলতেন - দ্যাখেন , মুরগির নিজস্ব একটা ফ্লেভার আছে। রসুন না দেওনের মতো, জল কম , হলুদ কম। দেখতে হইবো কষতে কষতে যেন সিদ্ধ হইয়া যায়।

দীপক: চল। খিদেও পেয়েছে।

তারপর ওরা দুজন পৌঁছে গেলো রাসবিহারী রোডের ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক। একটু এগুলেই , সেদিনের সেই শ্যাওলা সবুজ গলির গায়ে আজ নতুন রঙের প্রলেপ , ঝলমলে আলো ; সেই ঘুপচি ঘর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত , পাশাপাশি মাদুর কার্পেট ; কাঁচের দরজা ঠেলে , সেই লাল সিমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে ওরা উঠে গেলো দোতলায়। কোথাও তেল চিটচিটে বিছানা নেই , লুঙ্গি নেই , খয়ের রঙের দাঁত নেই , 'ব্রোভোন' কোম্পানির ইনহেলার নেই ; সূক্ষ্ম শরীরী তাঁকে , ওরা দেখতে পেলো - গলা ছুঁয়ে নেমে আসছে মেঘ , হৃদয় ডুব দিয়েছে মানস সরোবরে , সুরলোকে বসে গাইছেন - রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি ।

ওদের কথা শেষ। আমারও। রবীন্দ্র সায়রে হোক আবার দেবব্রত সিনান।

© দেবাশীষ গোস্বামী


No comments:

Post a Comment